৯: লেয়াকত আলি খানা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর, ১৯৫৩ সালে জেনারেল আইয়ুব খান ও ইস্কান্দার মির্জা যখন পাকিস্তানের শীর্ষ ক্ষমতায়, তখন জে. আইয়ুব খান আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন। মার্কিন কর্মকর্তারা জেনারেল আইয়ুব খানকে তাদের সামরিক স্থাপনা ও অস্ত্রশস্ত্র দেখাতে শুরু করল। আইয়ুব খানের এসব দেখার প্রতি আগ্রহ ছিল না। তিনি বারবার একটা কথাই বোঝাতে চাচ্ছিলেন, আমেরিকা যদি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করে, তাহলে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা আমেরিকার কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে লড়তে পারবে। জেনালের আইয়ুব বোঝাতে চাচ্ছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে মধ্যএশিয়া পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তান হয়ে ‘গরম পানি’ পর্যন্ত বাধা দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে আমেরিকার দরকার। পাকফৌজও এই কাজে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য পুরোদমে প্রস্তুত।
সোভিয়েতকে গরমপানি পর্যন্ত পৌঁছা ঠেকানোর এই পরিকল্পনা পাকবাহিনীর নিজস্ব উদ্ভাবন নয়। এই চিন্তা আরো একশ বছর বা তারও আগে থেকেই ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে ছিল। তারা রুশ সা¤্রাজ্যকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছু করেছিল।
জেনালের আইয়ুব খান যখন দেখলেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ তার কথায় কান দিচ্ছে না। তাকে শুধু সেনা ছাউনি, ক্যান্টনমেন্ট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। জেনারেল খান শেষে অতিষ্ঠ হয়ে মার্কিন সহকারি স্বরাষ্ট্র সচিব হেনরি বেরওয়াডকে বললেন: খোদার কসম, আমি এখানে সেনাব্যারাক দেখার জন্য আসিনি। আমাদের সেনা আপনাদের সেনা হতে পারে, যদি আপনার চান।
অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই, পাকনেতারা দেশের অর্থনীতি মজবুতির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, মজবুত সেনাবাহিনী গঠনের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। পাকনেতাদের আগ্রহ ছিল, কীভাবে নিজেদের সেনাশক্তি ব্যবহার করে, বিশে^র পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে আরো বেশি সুবিধা অর্জন করা যায়। ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা, শিল্পোন্নয়নের প্রতি তুলনামূলক কম মনোযোগ দেয়া হয়েছিল। এজন্য দেখা যায়, বর্তমানেও বিশে^র দেশ ও সরকারগুলোর কাছে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সম্পর্কের চেয়ে, পাক জেনারেলদের সাথে সম্পর্কের গুরুত্ব বেশি। পুরো দুনিয়া পাকিস্তানকে ‘গ্যারিসন স্টেট’ বা সামরিক দেশ হিসেবে দেখে; ২২ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে নয়। এসব কারণে পাক অর্থনীতি অনবরত ধুঁকতে থাকে আর মার্শাল ল বারবার ফুঁসতে থাকে।
১০: পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই কেন অনবরত আইএমএফ ও অন্যান্য বিশ^সংস্থার কাছে ঋণগ্রস্ত থাকে? প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান কেন ২২ বার আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য ধর্না দিয়েছে? এছাড়া আমেরিকা, চীন, জাপান, আরবদেশগুলোর কাছ থেকে নেয়া ঋণ তো আছেই। আর কোনো দেশ এতবেশি বার এইএমএফের কাছে গিয়েছে কি না সন্দেহ আছে। অন্য কোনো দেশ গেলেও পাকিস্তান প্রথম দুইতিন দেশের মধ্যেই থাকবে। উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর এই হতে পারে,
ক: প্রথম দিন থেকেই এতবড় বাহিনী পোষার মতো পর্যাপ্ত টাকা পাকিস্তানের হাতে ছিল না। কায়েদে আজমকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমেরিকার দ্বারস্থ হতে হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক দূরবস্থার দিকে তাকিয়ে, পাকবাহিনী নিজেই নিজের খরচ সংগ্রহ করার কাজে নেমে পড়েছিল। এ কারণে তাদের মধ্যে একধরণের স্বায়ত্বশাসনের ভাব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। আর শুরু থেকেই ‘পাকবাহিনী’ খোদ পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রপ্তানীযোগ্য ‘পণ্যে’ রূপান্তরিত হয়েছিল।
খ: পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সমস্যার আরেকটি বড় কারণ, দেশভাগের সময় পাকিস্তানের ভাগে একটা উল্লেখযোগ্য শিল্পনগরী পড়েনি। কলকাতা, বোম্বাই, মাদরাস সবই ভারতের হাতে চলে গিয়েছিল। পাকিস্তানকে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হয়েছিল। দেশভাগের পর মূলত পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে ইন্ডিয়া আগের আসল রাষ্ট্রই থেকে গিয়েছিল। তাদের নতুন করে কিছু করতে হয়নি।
গ: ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তান দুই টুকরা হয়ে গেল, একধাক্কায় দেশের জনসংখ্যা অর্ধেকের চেয়েও কমে গেল, তখনও সেনাবাহিনীর সংখ্যা প্রায় আগের মতোই থেকে গিয়েছিল। বাঙালি সেনা খুবই কম ছিল। ভৌগলিকভাবে পাকিস্তান ছোট হয়ে গিয়েছিল। এটাও পাক অর্থনীতির ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছিল।
ঘ: পাকনেতারা শুরু থেকেই মারাত্মক এক ভুল বারবার করে আসছিল, সেটা হল প্রতিবেশির সাথে চলমান সামরিক ও সীমান্ত বিবাদের সাথে বাণিজ্যকেও জুড়ে দেয়া। প্রতিবেশির সাথে যুদ্ধ-সংঘাত হয়েছে? ব্যস লেনদেন বন্ধ। আমদানি-রফতানি বন্ধ। অথচ বিশে^র অন্য দেশ ও জাতির দিকে তাকালে এর ব্যতিক্রম চিত্রই দেখা মেলে। তাইওয়ানের সাথে চীনের চিরবৈরিতা। তারপরও তাইওয়ানের সাথে চীন প্রতিবছর ১৮৯ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। দুইদেশে পর্যটক আসাযাওয়াতেও কোনো বাধা নেই। ভারতের সাথেও চীনের যুদ্ধ হয়েছে। এটাসেটা নিয়ে খিটিমিটি লেগেই আছে। ১০-টিরও বেশি স্থানে সীমান্তবিরোধ লেগে আছে। অরুনাচল, সিকিম, তিব্বত, আকসাই চীনে নিয়ে রেষারেষি চলছেই। এসব সত্ত্বেও ইন্ডিয়ার সাথে প্রতি বছর ১৪০ বিলিয়নের বেশি আমদানি-রপ্তানী লেনদেন হয়। আমেরিকা স্বাধীন হয়েছিল ব্রিটেন থেকে। অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী লড়াই করে আমেরিকা স্বাধীন হয়েছিল। তারপরও আমেরিকা একদিনের জন্যও বাণিজ্য বন্ধ