ভারতে সামরিক অভ্যুত্থান!
পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান হয়, বাংলাদেশে হয়, ভারতে হয় না কেন?
প্রশ্নটা বহুত পুরনো। বাংলাদেশে সামরিক অভুত্থ্যান হয়েছে, বার্মাতে তো হয়েই আছে। পাকিস্তানে এই পর্যন্ত ৪ বার মার্শাল ল জারি হয়েছে। নানা আঙ্গিকে এখনো হয়েই চলছে। পাশাপাশি দেশ হওয়ার পরও ইন্ডিয়াতে এখন পর্যন্ত একবারও সামরিক অভ্যুত্থান তো দূরের কথা, দৃশ্যমান প্রচেষ্টা পর্যন্ত হয়নি। এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও ১৯৬৬ সালে একবার সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা হয়েছিল, সেটাকে ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছিল। অভ্যুত্থানের প্রধান কুশীলব জেনারেল রিচার্ড ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের গ্রেফতার করে সাজা দেয়া হয়েছে।
কেন?
এক ইন্ডিয়ান ল্যাপটেন্যান্ট জেনারেল এস টি ভার্মা লিখেছেন, ১৯৬০ সালে যখন আমার বন্ধু আর্মি চীপ জেনারেল থিমায়ার সাথে মনখুলে গপশপ করার ইচ্ছা হত, তখন আমরা নাগিন ঝিল (লেক)-এ চলে যেতাম। সেখানে একটা বোট নিয়ে ঝিলের মাঝামাঝি গিয়ে মনের কথা খুলে বলতাম। এছাড়া ঘরে-বাইরে আর কোথাও মনের কথা বলাটা নিরাপদ বোধ করতাম না।
এই ঘটনা আইসবার্গের মাথা। ভারতে সামরিক বাহিনী কেমন নজরদারিতে থাকে, তার ছোট্ট এক নমুনা।
ভারতে কেন সামরিক অভ্যুত্থান হয় না, এর কারণ খুঁজতে একটু পেছনে যেতে হবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি রাজকীয় সেনাবাহিনী (Imperial Army) দরকার ছিল। পিপলস আর্মি বা জনগণের সুরক্ষার জন্য নয়, সাম্রাজ্য ও সম্রাটকে রক্ষা করার জন্য বাহিনী দরকার ছিল। ব্রিটিশরা এমন সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চেয়েছিল, যার শতভাগ আনুগত্য থাকবে রাজার প্রতি, উপনিবেশ স্থাপনকারী মনিবের প্রতি, ব্রিটিশ এম্পায়ারের প্রতি।
এজন্য তারা নতুন সেনা ও অফিসার রিক্রুট করার সময় ইংরেজরা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে একটি নীতিমালা মেনে চলত। তারা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকেই নতুন সদস্য সংগ্রহ করত। ইংরেজরা হিন্দুস্তানের এলাকাগুলোকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে নিয়েছিল,
১: মার্শাল রেস। যোদ্ধাজাতি। এই দলে ছিল শিখ, মুসলিম পাঞ্জাবি, হিন্দু জাট, ডোগরা, গোর্খা, ঘরওয়াল, পাঠান, আফ্রিদি। ব্রিটিশরা এই জাতিগোষ্ঠির লোকজনকেই সেনাবিভাগে ভর্তি করাত। এজন্য আমরা দেখব ব্রিটিশ আর্মির বিপুল সংখ্যক সদস্য পাঞ্জাবের পোটোহার বা উত্তরাঞ্চল থেকে রিক্রুট করা হয়েছে। নেপালের গোর্খাদের থেকে রিক্রুট করা হয়েছে। এরই বাইরে হিন্দুস্তানের অন্য এলাকা থেকে নামমাত্র সেনা রিক্রুট করা হয়েছে। ইংরেজ এই কাজ জেনেবুঝে, পরিকল্পিতভাবে করত।
২: ননমার্শাল রেস। অযোদ্ধাজাতি। এদের থেকে সেনা রিক্রুট করা হত না।
নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ভর্তি হওয়ার কারণে, নিজ রেজিমেন্টের সবাই শুধু নিজ এলাকার খবরাখবর পেতো। দেশের বাকি অঞ্চল সম্পর্কে বেখবর থাকত। অন্য এলাকার প্রতি তাদের এতটা মায়া বা দুর্বলতাও থাকত না। এখানেও ইংরেজদের বহুল ব্যবহৃত ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির কথা প্রযোজ্য। সেনারা ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার মানুষ দেখতে দেখতে, তারা একটা পরিবারের মতো হয়ে যেত। নিজেদেরকে বিশেষ কিছু ভাবতে শুরু করত। নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় সেরা মনে হত। কখনো গুলি চালানোর হুকুম হলে, তারা গুলি চালাতে দ্বিধায় ভুগত না। তারা তো পুরো দেশের প্রতিনিধিত্ব করত না। দেশের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতাই ছিল না। তাদের সমস্ত আনুগত্য, আন্তরিকতা ছিল স¤্রাটের জন্য। ব্রিটিশরাজের জন্য। তাদের অভিধানে নিজের জন্মাঞ্চল ছাড়া পাকভারতবাংলার সমস্ত অঞ্চলই বিদেশ। ভিনদেশ। হিন্দুস্তানের মতো আফ্রিকার টোগো, ঘানা ও নাইজেরিয়াতেও বেশিরভাগ সেনাসদস্য সেসব দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ভর্তি করাত। ইরাকে শীয়া জনসংখ্যা বিপুল হলেও, সেনাবাহিনীতে বেশিরভাগ সুন্নী মুসলিম গোত্র থেকে রিক্রুট করা হত। ফরাসিরা সিরিয়াতেও এমন করেছিল। সিরিয়ান সেনা অফিসার বেশিরভাগই সংখ্যালঘু আলাবি শিয়া সম্প্রদায় থেকে রিক্রুট করা হত।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে পরিবর্তন এসেছিল ১৯৪৬ সালে নির্বাচনের পর। জওহরলাল নেহেরু সরকার প্রধান হয়েছিলেন। তাকে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছিল। এই পদ ক্ষমতার দিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদের সমান ছিল। এই হিসেবে নেহেরুকে অখ- হিন্দুস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলা যেতে পারে। দায়িত্ব গ্রহণের পর ১২ সেপ্টেম্বরে আর্মির কমান্ডার ইন চীপ ও প্রতিরক্ষা সচিবের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠিতে ইন্ডিয়ান আর্মিকে আমূল বদলে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। চিঠির জবাবে পন্ডিত নেহেরুকে বলা হল, আপনার প্রস্তাব মানা হলে ব্রিটিশ আর্মির খোলনলচেই বদলে যাবে। নেহেরু তো সেটাই চাচ্ছিলেন। তিনি বারবার প্রস্তাবিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের তাকিদ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কথা ছিল, হিন্দুস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর এই সংস্কার করতেই হবে। ব্রিটিশরাজকে নিজের প্রস্তাব মানাতে না পারলেও, ইন্ডিয়া স্বাধীন হওয়ার পর, আর্মির সংস্কার করেই ছেড়েছেন। পন্ডিত মশায়ের সংস্কারগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবে, কেন ভারতে আর্মি ক্যু হয় না আর পাক-বাংলা-বার্মায় অনবরত ক্যু লেগেই থাকে।